প্রযুক্তি বিশ্বে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, যাকে বলা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, তাতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো। এই লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান দুই প্রতিযোগী, মেটা এবং OpenAI-এর মধ্যেকার উত্তেজনা এবার প্রকাশ্য রূপ নিল। এক অভাবনীয় পদক্ষেপে, মেটা সিইও মার্ক জাকারবার্গ প্রতিপক্ষ OpenAI-এর ঘর থেকেই তাদের সবচেয়ে মেধাবী এক গবেষককে নিজের দলে ভিড়িয়েছেন, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ গতিপথকে বদলে দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন শেংজিয়া ঝাও নামের একজন অসাধারণ प्रतिभाशाली গবেষক। তিনি এতদিন OpenAI-এর সাফল্যের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে কাজ করছিলেন। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে चर्चित ও শক্তিশালী AI মডেল, যেমন GPT-4 এবং ChatGPT তৈরিতে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো মেশিনকে কেবল তথ্য দেওয়া নয়, বরং সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করে মানুষের মতো যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করা, অর্থাৎ ‘রিজনিং মডেল’ তৈরিতে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ। এর পাশাপাশি, কৃত্রিমভাবে ডেটা তৈরি করে AI-কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো জটিল বিষয়েও তার গভীর জ্ঞান রয়েছে। এক কথায়, তিনি সেই বিরল প্রতিভাধরদের একজন, যারা জানেন কীভাবে একটি ভাষাগত মডেলকে véritable বুদ্ধিমত্তার কাছাকাছি নিয়ে যেতে হয়।
আর এই মহার্ঘ্য প্রতিভাটিকেই মার্ক জাকারবার্গ তার নতুন স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘মেটা সুপারইন্টেলিজেন্স ল্যাবস’-এর প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এটি কোনো সাধারণ নিয়োগ নয়। শেংজিয়া ঝাও সরাসরি জাকারবার্গের কাছে রিপোর্ট করবেন, যা প্রমাণ করে এই প্রজেক্টটি মেটা-র জন্য কতটা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তার সাথে এই ল্যাবটি যৌথভাবে পরিচালনা করবেন আরেকজন খ্যাতনামা গবেষক আলেকজান্ডার ওয়াং।
অনেকে ভাবতে পারেন, তাহলে মেটা-র কিংবদন্তি এআই বিজ্ঞানী ইয়ান লেকুন-এর কী হবে? মেটা খুব সতর্কভাবে তাদের কাঠামো সাজিয়েছে। ইয়ান লেকুন তার ‘FAIR’ ল্যাবে চিফ এআই সায়েন্টিস্ট হিসেবেই থাকছেন এবং তার মূল ফোকাস থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দীর্ঘমেয়াদী এবং মৌলিক গবেষণার ওপর। অন্যদিকে, শেংজিয়া ঝাও-এর নেতৃত্বাধীন সুপারইন্টেলিজেন্স ল্যাবের একমাত্র লক্ষ্য হবে দ্রুততম সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা।
বস্তুত, এই পদক্ষেপটি মার্ক জাকারবার্গের কয়েক মাসের নিরলস চেষ্টার চূড়ান্ত ফসল। গত গ্রীষ্ম থেকেই তিনি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বিশ্বের সেরা এআই গবেষকদের নিজের ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল শূন্য থেকে এমন একটি ‘ফ্রন্টিয়ার এআই ল্যাব’ তৈরি করা, যা প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় OpenAI বা Google DeepMind-কে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন সেরা ল্যাব থেকে গবেষকদের আনা, তাদের জন্য মেটা-র অফুরন্ত কম্পিউটিং শক্তি এবং পরিকাঠামো উন্মুক্ত করে দেওয়া—এই সবকিছুই ছিল একটি বড় পরিকল্পনার অংশ। শেংজিয়া ঝাও-এর যোগদানের মাধ্যমে সেই পরিকল্পনাটি এখন পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল এবং এই সুপার-ল্যাবটি তার যাত্রা শুরু করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।
এই ঘটনাটি নিছকই একটি চাকরি পরিবর্তন নয়, এটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধিপত্যের লড়াইয়ে এক সুস্পষ্ট শক্তির মহড়া। মেটা বুঝিয়ে দিল যে, তারা কেবল সামাজিক মাধ্যম বা মেটাভার্স নিয়েই বসে থাকবে না, বরং কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বা সুপারইন্টেলিজেন্স তৈরির দৌড়ে তারা সবচেয়ে আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমেছে। এই পদক্ষেপের ফলে OpenAI এবং Google-এর ওপর চাপ বাড়ল বহুগুণে, এবং প্রযুক্তি বিশ্ব এখন একটি আরও তীব্র ও উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিযোগিতার জন্য অপেক্ষা করছে।